সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বুনিয়াদ নির্মাণ

['অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক মহাবিপ্লব' গ্রন্থের দ্বাদশ অধ্যায়; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮২] 

জার্মানির সঙ্গে শান্তি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রকে অর্থনৈতিক পুনর্বাসনে প্রবৃত্ত হওয়ার এবং সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ কর্ম আরম্ভ করার সুযোগ দিয়েছিল।

সমাজতন্ত্রের পথের দিশা দেখানো দরকার হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক কমিউনিজমের প্রতিষ্ঠাতা কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস পুঁজিবাদ থেকে কমিউনিজমে উত্তরণ কার্যকর করার মূল উপায়গুলির রূপরেখা উপস্থিত করেছিলেন। মার্কসবাদীরা জানত এই পথের সাধারন দিশা ও প্রধান প্রধান শ্রেণী শক্তির কথা, কিন্তু নির্মাণ কর্মের মূর্ত পথ ও উপায় তারা জানতে পারেনি। একথা পরিষ্কার ছিল এই সমস্ত পথ ও উপায় অনেকখানি নির্ভর করবে বিদ্যমান অবস্থার উপরে, বিশেষ বিশেষ বিকাশের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের উপরে, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, প্রভৃতির উপরে। ১৯১৭ সালে লেনিন বলেছিলেন, ‘আমরা দাবি করি না যে সর্বশেষতম অনুপুঙ্খ পর্যন্ত সমাজতন্ত্রের পথ মার্কস জানেন। এধরণের কিছু দাবী করাটা অর্থহীন। আমরা যেটা জানি তা হল এই পথের গতিমুখ এবং সেই পথের অনুসারী শ্রেণী শক্তিগুলিকে; সুনির্দিষ্ট ব্যবহারিক অনুপুঙ্খগুলি প্রকট হয়ে উঠবে একমাত্র লক্ষ লক্ষ মানুষের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই তারা যখন সবকিছু নিজেদের হাতে নেবে’।

এখন যখন সেটি আশু ব্যবহারিক কাজ হয়ে দাঁড়াল, তখন জনসাধারণকে তৎপরতার এক সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি দেওয়া দরকার। রাশিয়ার অবস্থাকে যথাযথভাবে গণনা করে এই ধরনের এক বিজ্ঞানসম্মত কর্মসূচি লেনিন সূত্রায়িত করেন ১৯১৮-র বসন্তকালে, তাঁর ‘সোভিয়েত রাজের আশু কর্তব্য’ রচনায়। তিনি সমাজতন্ত্র নির্মাণের একটি পরিকল্পনা ছকে দেন, প্রলেতারীয় একনায়কতন্ত্রের অর্থনৈতিক কর্মনীতির মূলনীতি প্রণয়ন করেন এবং সমাজতন্ত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সোভিয়েত রাষ্ট্রের সৃষ্টিশীল ভূমিকা বিশদভাবে দেখান। প্রলেতারীয় রাষ্ট্রের অভূতপূর্ব পরিসরে কতকগুলি কর্তব্য সম্পাদন করা দরকার ছিল: অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা সংগঠিত করা, জাতিব্যাপী শ্রমের পরিকল্পনা করা, শ্রম ও উপভোগের পরিমাপ নিয়ন্ত্রণ সংগঠিত করা, উৎপাদনী শক্তিগুলির প্রসার ঘটানো, জনগণের সাংস্কৃতিক স্তর উন্নীত করা, এবং তার ভিত্তিতে, পুঁজিবাদী দেশগুলির তুলনায় শ্রম উৎপাদনশীলতার উচ্চতর স্তর অর্জন করা।

সোভিয়েত রাষ্ট্রের সামনের নতুন কর্তব্যগুলির চরিত্র নির্ণয় করতে গিয়ে লেনিন বলশেভিক পার্টির অতিক্রান্ত ঐতিহাসিক পথ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা, বলশেভিক পার্টি, রাশিয়াকে প্রত্যয়জনকভাবে বুঝিয়েছি। রাশিয়াকে আমরা জয় করে নিয়েছি ধনীর কাছ থেকে গরীবের জন্য, শোষকদের কাছ থেকে শ্রমজীবী জনগণের জন্য। এখন আমাদের রাশিয়াকে প্রশাসন  করতে হবে। আর বর্তমান পরিস্থিতির সমগ্র বৈশিষ্ট্য দুরূহতা, নিহিত রয়েছে জনগণকে বোঝানোর এবং অস্ত্রবলে শোষকদের দমন করার প্রধান কাজ থেকে প্রশাসনের প্রধান কাজে উত্তরণের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলি বোঝার মধ্যে’।

বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে সাফল্যগুলি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তোলার পদ্ধতি পরিবর্তিত করা সম্ভব ও প্রয়োজনীয় করে তুলেছিল। ‘লাল রক্ষী আক্রমণের’ কালপর্বটি মোটের উপরে, শেষ হয়েছিল। প্রলেতারিয়েত যে শুধু পুঁজিপতিদের সশস্ত্র প্রতিরোধ চূর্ণ করেছিল এবং বুর্জোয়া আমলাতন্ত্রের অন্তর্ঘাতের অবসান ঘটিয়েছিল তাই নয়, প্রশাসনের কিছু অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছিল। এখন লক্ষ্য ছিল ‘পুঁজিপতিদের আরও দখলচ্যুত করার অতি সহজ কাজটি থেকে যে-অবস্থায় বুর্জোয়াশ্রেণীর টিকে থাকা অথবা এক নতুন বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভব হওয়া অসম্ভব হয়ে উঠবে সেই অবস্থা সৃষ্টির আরও অনেক জটিল ও দুরূহ কাজে উত্তরণ’ ঘটানো। অর্থনীতির পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা ও বর্ধিত শ্রম উৎপাদনশীলতা সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন ও বণ্টনের হিসাব রাখা ও তা নিয়ন্ত্রণ করার উপরে লেনিন বিশেষ তাৎপর্য আরোপ করেছিলেন। শ্রমের মাত্রার এবং উপভোগের মাত্রার হিসেব ও নিয়ন্ত্রণ ছিল পেটি-বুর্জোয়া উপাদানের বিরুদ্ধে, অপরের শ্রম উপযোজন, মুনাফাবাজ, অলস কর্মবিমুখ ও সমাজতান্ত্রিক সম্পত্তি লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রধান উপায়।

সেই সময়ে রাশিয়ায় ছিল পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপাদান: ১) পিতৃতান্ত্রিক, অর্থাৎ অনেকাংশে প্রাকৃতিক কৃষক অর্থনীতি; ২) ক্ষুদ্র পণ্য উৎপাদন, প্রধানত বাজারের জন্য উৎপাদনকারী কৃষক খামার; ৩) ব্যক্তিগত অর্থনীতিপ্রধান পুঁজিবাদ - পুঁজিবাদী উদ্যোগসমূহ ও কুলাকদের খামার; ৪) রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ - রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী উদ্যোগসমূহ; ৫) সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা - রাষ্ট্রের মালিকানাধীন উদ্যোগসমূহ এবং উদীয়মান যৌথ খামারগুলি। ক্ষুদ্র-পণ্য অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন ছিল এবং তা মুনাফাবাজী ও উৎপাদনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করতো; এই ক্ষুদ্র-পণ্য অর্থনীতিরই প্রাধান্য ছিল। সেই সময়ে, গ্রামাঞ্চলে কুলাকরা যার পৃষ্ঠপোষক ছিল সেই পেটি-বুর্জোয়া উপাদানই ছিল সোভিয়েত ক্ষমতার পক্ষে প্রধান বিপদ।

জাতিব্যাপী হিসাব রক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ, শ্রম উৎপাদনশীলতার প্রসার এবং পেটি বুর্জোয়া উপাদানটি খর্ব করাকে লেনিন রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের বিভিন্ন ধরনকে (অর্থাৎ, কতকগুলি শর্তে প্রলেতারীয় ক্ষমতা যে পুঁজিবাদকে থাকতে দেয়) ব্যবহার করার প্রশ্নটির সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক যুক্ত করে বিচার করতেন। তিনি মনে করতেন যে এক - একটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের প্রসার ঘটানোর জন্য ব্যক্তিগত পুঁজি আকৃষ্ট করতে দেওয়া যেতে পারে, মিশ্র (রাষ্ট্রীয়-ব্যক্তিগত) উদ্যোগ ও ট্রাস্ট তৈরি করা এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে আসতে প্রস্তুত পুঁজিপতিদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করা যেতে পারে। প্রলেতারীয়েতের একনায়কতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ জনগণের ক্ষমতার পক্ষে বিপদ স্বরূপ ছিল না। সেই সঙ্গে, লেনিন মনে করতেন রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ পেটি-বুর্জোয়া উপাদানটির বিরুদ্ধে লড়াই সহজতর করে তুলবে, রাষ্ট্রকে উৎপন্ন সামগ্রীর একটা অংশ দেবে এবং দেশের উৎপাদনী শক্তিগুলিকে প্রসারিত করতে সাহায্য করবে।

লেনিন জোর দিয়ে বলেছিলেন যে সমাজতন্ত্রের বিজয়ে এবং জনগণের জীবন মান উন্নীত করার একটি বড় শর্ত হলো শ্রম উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। তিনি একে যুক্ত করেছিলেন দেশের শিল্পায়ন ও বৈদ্যুতিকরণের সঙ্গে, আধুনিকতম বৈজ্ঞানিক ও কৃৎকৌশলগত কৃতিত্বের সদ্ব্যবহারের সঙ্গে, জনগণের উচ্চতর সাধারণ শিক্ষাগত ও কৃৎকৌশলগত মান অর্জনের সঙ্গে। তিনি লিখেছেন: 'শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে তোলার জন্য সর্বপ্রথমেই দরকার এই যে বৃহদায়তন শিল্পের বৈষয়িক ভিত্তি সুনিশ্চিত করা হবে, যথা, জ্বালানি, লোহা, ইঞ্জিনিয়ারিং ও রাসায়নিক শিল্পের উৎপাদনের বিকাশসাধন'। 

অক্টোবর বিপ্লব ও উৎপাদনের উপায়সমূহের সামাজিকীকরণের ফলে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রই হয়ে উঠেছিল ইতিহাসে সর্বপ্রথম রাষ্ট্র, অর্থনৈতিক বিকাশ পরিকল্পিত করার সুযোগ যে পেয়েছিল ।

ইঙ্গিতবহ বিষয়টি এই যে বিশৃঙ্খলা, দুর্ভিক্ষ ও কাঁচামাল ও জ্বালানির অভাব সত্ত্বেও সোভিয়েত সরকার ১৯১৮ সালে অর্থনীতির বৈদ্যুতিকরণ এবং উৎপাদনী শক্তিগুলির প্রসারের পরিকল্পনা করতে শুরু করেছিল। সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক পরিষদ-গঠিত রাশিয়ায় শক্তির উৎস সন্ধানের জন্য কমিশন ১৯১৮-র গোড়ার দিকে তার কাজ শুরু করেছিল। বৈদ্যুতিকরণের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল পেত্রগ্রাদে, কেন্দ্রীয় শিল্পাঞ্চলের বৈদ্যুতিকরণের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল মস্কোয় এবং আরেকটি কমিটি গঠিত হয়েছিল দনবাসের বৈদ্যুতিকরণের পরিকল্পনা করার জন্য। বৈদ্যুতিকরণের পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজে লাগানো হয়েছিল শীর্ষ স্থানীয় বিজ্ঞানীদের। জুলাই ১৯১৮-তে, লেনিনের এক সুপারিশ অনুযায়ী, গণ-কমিসার পরিষদ ভলখভ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। এই বিদ্যুৎশক্তি কেন্দ্রটির প্রথম ডিজাইনটি তৈরি করেছিলেন বিশিষ্ট বিদ্যুৎশক্তি ইঞ্জিনিয়ার গ.ও. গ্রাফতিও, ১৯১১ সালে। কিন্তু, বিপ্লবের আগে তা কাজে পরিণত করা হয়নি। সোভিয়েত সরকার প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করে এবং প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। এছাড়াও, গণ-কমিসার পরিষদ মস্কোর কাছে শাতুরায় একটি বিদ্যুতশক্তি কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। দুটি বড় বড় অঞ্চলের একটি অখণ্ড অর্থনৈতিক সংগঠন হিসাবে উরাল-কুজনেৎস্ক সমাহারের বিকাশ সাধন, রেলপথ নির্মাণ এবং তুর্কিস্তানে সেচ ব্যবস্থা সৃষ্টির এক কর্মসূচি তৈরি করা হয়।

লেনিন বলেন, বলসেভিক পার্টির একটি আশু লক্ষ্য হলো শ্রমজীবী জনগণকে সমাজতান্ত্রিক শৃঙ্খলার চেতনায় শিক্ষিত করে তোলা। বিপ্লবের পর, শ্রমিকরা কাজ করতে শুরু করেছিল শোষকদের জন্য নয়, নিজেদের জন্য; শ্রমজীবী জনগণের বৈষয়িক অবস্থা এবং সোভিয়েত রাষ্ট্রের শক্তি এখন নির্ভর করছিল তাদের শ্রমের উপরে, উৎপাদনের সম্প্রসারণের উপরে। কিন্তু, বহু শ্রমিকই একথা বুঝতে পারেনি যে শ্রম উৎপাদনশীলতা বাড়ানোটা এখন তাদেরই কাজ। অক্টোবর বিপ্লবের পরবর্তী প্রথম কয়েক মাসে রাশিয়ার কিছু কিছু কারখানার পরিস্থিতি স্মরণ করে ন.ক. ত্রুপস্কায়া লিখেছেন যে একদিন একজন শ্রমিক শিক্ষা-বিষয়ক গণ-কমিসারিয়েটে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে এবং বলে: 'আমাদের কারখানায় আজ কেউ কাজ করছে না। গতকাল আমরা একটা সাধারণ সভা করেছি, তাতে সবাই বলেছে যে বাড়িতে প্রচুর কাজ জমে গেছে। আমরা স্থির করেছি আজ কাজ করবো না। এখন তো আমরাই কর্তা'। দেশের ভাগ্যের জন্য, উৎপাদনের জন্য শ্রমিকদের নিজেদেরই উপরে যে বিরাট দায়িত্ত্ব বর্তেছে, সেকথা ধৈর্য সহকারে ব্যাখ্যা করে অর্থনৈতিক নির্মাণ কর্মের একেবারে শুরু থেকেই এই ধরনের মনোভাব দূর করা দরকার ছিল। কারখানাগুলোতে সচেতন শৃঙ্খলা বোধ গড়ে তোলার দিকে যথেষ্ট নজর দেওয়া হয়েছিল। লেনিন বলেছিলেন, পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের কালপর্বে শ্রম শৃঙ্খলাবোধ সঞ্চারিত করতে হবে বুঝে, কিন্তু যারা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে তাদের ক্ষেত্রে, অলস কর্মবিমুখ, পরগাছাদের ক্ষেত্রে, যারা 'যত পার নিয়ে নাও, কিন্তু কোনো জিনিসের জন্য দিওনা কিছুই', এই পেটি-বুর্জোয়ানীতি অনুযায়ী বেঁচে থাকে তাদের সকলের ক্ষেত্রে বাধ্বচধকতা প্রয়োগ করতে হবে। 

লেনিন লিখেছিলেন, পার্টি ও সরকারের একটা ছাপিয়ে যাওয়ার আন্দোলন সংগঠিত করা উচিত, এটি গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের উপরে মানুষের শোষণের অবসান ঘটিয়ে এবং শ্রমজীবী জনগণকে উৎপাদনের উপায়সমূহের প্রভু করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব জনগনকে সৃষ্টিশীল উদ্যোগের এক সীমাহীন সুযোগ দিয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক সমকক্ষতা-অর্জনাভিযানকে লেনিন শ্রম উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে তোলার সচেতন শৃঙ্খলাবোধ সঞ্চারিত করার এবং জনগনকে সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজে টেনে আনার এক নতুন পদ্ধতি বলে গণ্য করতেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে নতুনের অঙ্কুরগুলির দিকে পার্টিকে নিরন্তর মনোযোগ দিতে হবে, অগ্রসর কারিগরির জ্ঞান অধ্যয়ন করতে হবে এবং সমস্ত মানুষের অধিগম্য করে তুলতে হবে; তিনি বলেছিলেন যে '...দৃষ্টান্তবলই সর্বপ্রথম জনগনকে প্রভাবিত করতে সক্ষম'। 

অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সুদক্ষ ধরন ও পদ্ধতি বার করার উপরে লেনিন বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। সাধারণ রীতি ছিল, উদ্যোগগুলিতে এক যৌথ ব্যবস্থাপনা তৈরি করা: শ্রমিকরা তাদের নির্বাচনভিত্তিক সংগঠনগুলির মারফৎ এবং জন-সমাবেশ ও সভায় সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিত। এর কারণ ছিল সেই সময় কর বিদ্যমান অবস্থা, যখন ব্যবস্থাপনার পুঁজিবাদী ধরণগুলি পরিত্যক্ত হচ্ছিল এবং শ্রমিকদের নিজস্ব কোনো উৎপাদন সংগঠক ছিল না। কিন্তু, যৌথ ব্যবস্থাপনার ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল, তার একটি হল এই যে গৃহীত সিদ্ধান্তের জন্য কারও কোনো নির্দিষ্ট দায়িত্ব ছিল না।

১৯১৮-র বসন্তকালে আরব্ধ নির্মাণ কর্মের নতুন পর্যায়ে, শ্রম পক্রিয়ার সঠিক সংগঠনের মূলে শর্ত হিসেবে এক জনের ব্যবস্থাপনা চালু করার প্রশ্নটি লেনিন তোলেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন ব্যক্তিদের এবং ব্যবস্থাপক কর্তৃপক্ষের কাজের উপরে শ্রমজীবী জনগণের নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে মেলাতে হবে এক একজনের ব্যবস্থাপনাকে। তিনি একে সম্ভাব্য আমলাতান্ত্রিক বিকৃতির বিরুদ্ধে সুনিশ্চিত গ্যারান্টি বলে মনে করেন। তিনি দেখান সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার অন্তর্নিহিত মূলনীতিটি হতে হবে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি, ভাষান্তরে, স্থানীয় সংস্থাগুলির উদ্যোগ ও শ্রমজীবী জনসাধারণের সৃষ্টিশীল কাজকর্মের প্রসারের সঙ্গে কেন্দ্রীকৃত পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের মিলন।

তিনি লেখেন, সমাজতন্ত্রের জন্য দরকার শিল্পে ও কৃষিতে বৃহদায়তন সামাজিক উৎপাদন। বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের ছাড়া, বিশেষজ্ঞদের ছাড়া বৃহদায়তন যন্ত্র-শিল্প সংঘটিত করা যায় না। বৃহদায়তন শিল্প পরিচালনা করতে পারে এমন লোকদেরই অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার জন্য দরকার। সোভিয়েত ক্ষমতার প্রতি নিবেদিত প্রাণ এমন লোক খুবই সামান্য, এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করার জন্য সময় দরকার। নতুন সৃষ্টিশীল কাজে পুরানো বিশেষজ্ঞদের ব্যবহার করা উচিত কি না, এই নিয়ে সেই সময়ের শ্রমিকদের মধ্যে চুক্তি তর্ক চলত। এইসব বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশই যোগসূত্র ছিল বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে, তারা এসেছিল বুর্জোয়া পরিবেশ থেকে। সোভিয়েত ক্ষমতাকে তারা স্বীকার করেনি এবং অংশগ্রহণ করেছিল অন্তর্ঘাতে। লেনিন বলশেভিক পার্টিকে হুঁশিয়ার করে দেন যে এই বিশেষজ্ঞরা এখনই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারবে না, ধৈর্য সহকারে তাদের পুন:শিক্ষিত করতে হবে। বৃহদায়তন এক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি সংগঠিত করার জন্য বুর্জোয়া বিশেষজ্ঞদের ব্যবহার করা, তাদের সঙ্গে বিচক্ষণতা ও মনোযোগ সহকারে আচরণ করা এবং তাদের একটা বৈষয়িক প্রণোদনা দেওয়া দরকার ছিল। জনৈক প্রযুক্তিবিদ প.আ. কোজমিন পরবর্তীকালে লেনিনের সঙ্গে তার এক কথোপকথনে স্মরণ করেছেন: 'কমরেড কোজমিন, ইঞ্জিনিয়ারদের স্মোলনি ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসুন কারণ বিশেষজ্ঞদের না পেলে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব - যাঁরা কাজ করতে আসবেন তাঁরা পুঁজিপতিদের কাছ থেকে যে ব্যবহার পেতেন তার চাইতে ভালো ব্যবহার পাবেন। পরে তাঁরা বুঝতে পারবেন যে তাঁরা এক মহৎ প্রকল্পে অংশগ্রহণ করেছেন'। 

প্রলেতারিয়েতের পুঁজিবাদী উদযাপনের সংগঠকদেরও ব্যবহার করা দরকার ছিল। ট্রাস্ট, সিন্ডিকেট ও ব্যাংকগুলির ডিরেক্টরদের সঙ্গে সোভিয়েত সরকার আলোচনা করতে প্রস্তুত ছিল। সরকার তাদের বলেছিল: 'রাষ্ট্রীয় নিয়ম মেনে নিন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে মেনে নিন; জনসমষ্টির পুরনো স্বার্থ, অভ্যাস ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত অবস্থায় পরিপূর্ণ বিলুপ্তির পরিবর্তে, আপনারা পাবেন রাষ্ট্রীয় নিয়মের দ্বারা এই সবের ক্রমান্বিত পরিবর্তন....' 

রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের উপাদানগুলিকে কাজে লাগানোর প্রথম চেষ্টা ক্ষমতা করে ১৯১৭ সালের শেষ দিকে যখন গণকমিসার পরিষদের প্রতি নিষ্ক্রিয় শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি ও ইঞ্জিনিয়ার আ.প. মেশ্চেরস্কির নেতৃত্বাধীন একদল পুঁজিপতিদের সঙ্গে আলোচনা চালায়। এই আলোচনার বিষয় ছিল সরমভো-কলোমনা শিল্প-অর্থলগ্নি গোষ্ঠীর ভিত্তিতে এক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা, যার আওতায় থাকবে রেল-ইঞ্জিন নির্মাণ শিল্পের ৮৮ শতাংশ, রেল গাড়ী শিল্পের ৫০ শতাংশ, কিছু খনি এলাকা ও ধাতু বিদ্যাগত কারখানা। কিন্তু মেশ্চেরস্কি গোষ্ঠী অগ্রহনীয় শর্ত উপস্থিত করে। নভেম্বর ১৯১৭ থেকে এপ্রিল ১৯১৮ পর্যন্ত আলোচনা চলে কিন্তু কোনো মতৈক্যে উপনীত হওয়া যায় না। ইতিমধ্যে, সোভিয়েত অর্থনৈতিক সংস্থাগুলি এবং শ্রমিকদের সংগঠনগুলি ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা জাতীয়করণ ও সেগুলির ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্রীয় সমিতি গঠনের উপযোগী অবস্থা সৃষ্টি করে।

২৯শে ফেব্রুয়ারি, ১৯১৮ তারিখে কলোমনা কারখানার সংগঠনগুলি স্থানীয় সোভিয়েত ও ধাতু শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে মেশ্চেরস্কির নেতৃত্বাধীন পরিচালক পর্ষদের কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোচনা করে এবং এই মত পোষণ করে যে এই সমস্ত কার্যকলাপ শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থের পরিপন্থী। কেন্দ্রীয় সংগঠনগুলিকে ও গণকমিশার পরিষদকে জয়েন্ট-স্টক কোম্পানির কাছ থেকে কলোমনা কারখানা গ্রহণ করে সেটিকে রুশ প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তিতে পরিণত করার জন্য অবিলম্বে অনুরোধ জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 

চর্ম শিল্প ও সুতাকলগুলির মালিকরা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ মেনে নেয়। এই শাখাগুলির ব্যবস্থাপক কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি প্রধানত শ্রমিকদের নিয়েই গঠিত ছিল, তারা পুঁজিবাদী শিল্পের সংগঠকদের জ্ঞানকে কাজে লাগায়। পুঁজিপতিদের কাছ থেকে সুতাকল শ্রমিকদের শিল্প ব্যবস্থাপনা শেখার প্রয়াসের প্রশংসা করেন লেনিন।

সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকর্মের জন্য লেনিনের পরিকল্পনাটি প্রলেতারীয় নিয়ম একনায়কতন্ত্রের সমস্ত শত্রুর বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। বামপন্থী কমিউনিস্টরাও সেটিকে আক্রমণ করে। রাষ্ট্রীয় হিসাবরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ, শ্রম শৃঙ্খলা বোধ গড়ে তোলা, একজনের ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন, বুর্জোয়া বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ ও রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ ব্যবহারের বিরুদ্ধে তারা আপত্তি তোলে বুর্জোয়া রীতিতে ফিরে যাওয়ার সামিল বলে। কিন্তু লেনিনের পরিকল্পনা রূপায়ণে বাধা দেওয়ার জন্য বামপন্থী কমিউনিস্টদের প্রচেষ্টার কোন ফল হয়নি। সেরা শ্রমিক ও কমিউনিস্টরা শ্রম শৃঙ্খলা সুদৃঢ় করা ও শ্রম উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রথম সাফল্য অর্জন করে সেই ১৯১৮ সালের বসন্তকালেই।

এই সাফল্যগুলির অন্যতম সহায়ক বিষয়টি ছিল সশস্ত্র বাহিনী থেকে দক্ষ শ্রমিকদের প্রত্যাবর্তন। সেই সঙ্গে, যুদ্ধের সময়ে কৃষি থেকে যাদের শিল্পে ঢোকানো হয়েছিল, শহর থেকে সেই শ্রমিকদের বহির্গমন ঘটেছিল। এইভাবে কারখানাগুলো মুক্ত হয়েছিল পেটি-বুর্জোয়া বর্গ থেকে, যে-বর্গের চেষ্টা ছিল 'নিজেদের জন্য আরও বেশি দখল করে নেওয়া'।

শ্রম শৃঙ্খলা সুদীর্ঘ করার প্রচেষ্টায় দেখা যায় যে শিক্ষা ও বাধ্যবাধকতা দুয়েরই আশ্রয় নেওয়া দরকার। ১৯১৮-র বসন্তকালে বহু কারখানায় গঠিত হয় সহকর্মী শ্রমিকদের আদালত। শ্রম শৃঙ্খলা ভাঙার জন্য এইসব আদালত যে দন্ডাদেশ দিত তা হল তিরস্কার, ট্রেড ইউনিয়ন থেকে বহিষ্কার অথবা কাজ থেকে বরখাস্ত করা।

শ্রম শৃঙ্খলা সুদৃঢ় করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় বলশেভিক শ্রমিকরা, তারা অন্যের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ১৯১৭-র ১৯১৮-র গোড়ার দিকে সর্বাগ্রগণ্য শ্রমিক সংঘগুলি তাদের কারখানায় কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ১৯১৮-র বসন্তকালে তা হয়ে ওঠে এক ব্যাপক গণ-আন্দোলন। ব্রিয়ানস্ক কারখানার শ্রমিকদের দৃষ্টান্ত জাতিব্যাপী প্রচার লাভ করে। ফেব্রুয়ারির ১৯১৮তে পুঁজিপতিদের অন্তরঘাতের দরুন এই কারখানাটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এটির জাতীয়করণের পর শ্রমিকরা উৎপাদন সংঘটিত করার দায়িত্ব নেয়, যদিও কাজটা ছিল কঠিন। কারখানাটি উৎপন্ন করত শুধু সমরোপকরণ, কিন্তু এখন শ্রমিকরা এটিকে অসামরিক উৎপাদনের জন্য তৈরি করে। ৯মে তারিখে কারখানা কমিটি ও শ্রমিকদের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ অস্থায়ী আভ্যন্তরিক নিয়মাবলী প্রণয়ন করে, তাতে কঠোর শ্রমশৃঙ্খলার ব্যবস্থা করা হয়। কাজের সময়ে সভা নিষিদ্ধ করা হয়, শ্রমিকরা প্রকৃতই যেটুকু কাজ সম্পন্ন করেছে শুধু তার জন্যই পারিশ্রমিক পায়, এবং শ্রমশৃঙ্খলা লঙ্ঘনের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়।

এই দলিলটির মূল কথা ছিল এই যে উৎপাদনের ক্ষেত্রে একজনের ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। তাতে বলা হয়েছিল: উৎপাদনের জন্য যারা দায়ী তারা ছাড়া অর্থাৎ কারখানার ম্যানেজার এবং কর্মশালা ও বিভাগগুলির প্রধানরা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তির নির্দেশ পালন করা চলবে না। লেনিন ব্রিয়ানস্ক নিয়মাবলির উচ্চ প্রশংসা করেন এবং অন্যান্য কারখানায় তা গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। 

ব্রিয়ানস্ক কারখানার শ্রমিকদের জন্য চিকিৎসাগত সাহায্য সংঘটিত করা হয়। তাদের আবাসনের উন্নতি বিধান করা হয়। কারখানায় গঠিত হয় এক জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়। এক নতুন সমাজতান্ত্রিক শ্রম শৃঙ্খলার অভিযানে শ্রমিকরা সক্রিয়ভাবে যোগ দেয়। ফলে উৎপাদনের পরিকল্পনা রূপায়িত হয় এবং রেলগাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে শ্রম উৎপাদনশীলতা গিয়ে পৌঁছায় ১৯১৩ সালের স্তরে।

শৃঙ্খলা সুদীর্ঘ করার ফলে অন্যান্য কারখানাতেও উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়। পেত্রগ্রাদের ওয়েস্টিংহাউস ব্রেক কারখানায় উৎপাদন বাড়ে পাঁচ গুণ: ধাতু কারখানা বলটিক জাহাজ নির্মাণ কারখানা ও অন্যান্য উদ্যোগে ১৯১৮-র প্রথম ক-মাসে শ্রম উৎপাদনশীলতা বাড়ে ৫০-১০০ শতাংশ; কুজবাস অঞ্চলের সুদজেনকা খনিতে ডিসেম্বর ১৯১৭-র তুলনায় ১৯১৮-র বসন্তকালে কয়লা উৎপাদন বাড়ে তিনগুণ।

জনগণের দ্বারা উৎপাদনের হিসাব রক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য শিল্পে ও পরিবহনে কঠোরতম শ্রমশৃঙ্খলা ও শ্রম উৎপাদনশীলতার উচ্চতর স্তরের জন্য প্রয়াসের পাশাপাশি সোভিয়েত ক্ষমতা অন্তর্ঘাত, মুনাফাবাজি ও চুরির বিরুদ্ধে সংগ্রাম তীব্র করে তোলে। জনগণের সাহায্যে চেকা খাদ্য ও বিভিন্ন সামগ্রীর গোপন মজুত ভান্ডার আবিষ্কার করে এবং মুনফাবাজদের গ্রেফতার করে। দেশের অর্থনীতিকে যে মুনাফাবাজি দুর্বল করেছিল তাতে সক্রিয় বহু বিদেশি চরের স্বরূপ চেকা উদঘাটন করে। ব্রেস্ত চুক্তি অনুযায়ী জার্মানির উপস্থিত করা সমস্ত সম্পত্তির নিদর্শন পত্রের বিনিময়ে অর্থ দিয়ে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের দায়মুক্ত হবার কথা ছিল। বেশকিছু মুনাফাবাজ কতকগুলি খনির শেয়ার জার্মানির কাছে বিক্রি করতে চেষ্টা করছিল, তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। জার্মান কূটনীতিকরা মূল্যবান জিনিসপত্র কিনে নিয়ে সেগুলি জার্মানিতে পাঠাতেন কূটনৈতিক মালপত্রের ছদ্মবেশে। তা আবিষ্কৃত হয় এইভাবে। মস্কোর এক রেল স্টেশনে একজন মালবাহী 'সমর মন্ত্রক, বার্লিন' লেখা একটি বাক্স ফেলে দেয়। বাক্স থেকে বেরিয়ে পড়ে সোনা ও রুপোর জিনিসপত্র, রুশ ঋণপত্র ও অন্যান্য সম্পত্তির নিদর্শনপত্র। চেকা এই লুঠ বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

অর্থনীতির সংগঠন-সংক্রান্ত প্রশ্নগুলি মীমাংসা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল অর্থনৈতিক পরিষদগুলির ১ম সারা-রাশিয়া কংগ্রেস; পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে এই কংগ্রেস আহুত হয় ২৬ মে ১৯১৮ তারিখে। এই কংগ্রেসে লেনিন বলেন যে অর্থনৈতিক সংস্থাগুলির কাজে অনেক কিছুই ত্রুটিপূর্ণ, অসম্পূর্ণ ও অসংগঠিত, কিন্তু এতে আশঙ্কার উদ্রেক হওয়া উচিত নয়; সমাজের অর্থনৈতিক বনিয়াদ ঢেলে সাজার সুবিশাল কাজে অসংখ্য প্রারম্ভিক উপকরণ নিয়ে এগোনোর সম্ভাবনা নেই।

কেন্দ্র ও স্থানীয় অঞ্চলগুলির মধ্যে এবং কারখানাগুলোর এক-ব্যক্তিক ও যৌথ ব্যবস্থাপনার মধ্যেকার সম্পর্ক কংগ্রেসে আলোচিত হয়। সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক পরিষদের প্রতিবেদনে জোর দিয়ে বলা হয় যে শিল্পের ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রিকৃত করতে হবে, উদ্যোগগুলিকে অর্থনৈতিক পরিষদগুলির অধীনস্থ করতে হবে। প্রশ্নটির এই সূত্রায়নের বিরোধিতা করে বামপন্থী কমিউনিস্টরা, তারা যুক্তি তোলে যে কেন্দ্রের কাজ ব্যবস্থাপনা করা নয়, নিয়ন্ত্রণ করা। শিল্পের কেন্দ্রিকৃত ব্যবস্থাপনার জন্য লেনিনের পরিকল্পনার সঙ্গে এই বিকেন্দ্রীকতাবাদী দৃষ্টিকোণের কোন মিলই থাকা সম্ভব ছিল না।

দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে এবং অর্থনৈতিক নীতি সম্পর্কে কংগ্রেসের প্রস্তাবে বলা হয় যে সোভিয়েত ক্ষমতার চালু করা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলির ফলে গ্রামাঞ্চলে জমির মালিকানার বিলুপ্তি ঘটেছে এবং দেশের অর্থনৈতিক জীবনের ব্যবস্থাপনা থেকে বুর্জোয়া শ্রেণীর অপসারণ ঘটেছে। ঘোষণা করা হয় যে মূল গুরুত্বসম্পন্ন শিল্পগুলির জাতীয়করণ সম্পূর্ণ করতে হবে।

এই কংগ্রেসের পর সমস্ত শিল্পের জাতীয়করণ ত্বরান্বিত করে তোলা হয়। এপ্রিল ১৯১৮তে বাণিজ্য ও শিল্প বিষয়ক গণকমিসারিয়েট বাণিজ্যিক ও শিল্প উদ্যোগগুলির ক্রয় বিক্রয় অথবা এই সমস্ত উদ্যোগ সংক্রান্ত লেনদেন নিষিদ্ধ করে, আর গণ-কমিশার পরিষদ সমস্ত শেয়ার ও বন্ডের রেজিস্ট্রিকরন বাধ্যতামূলক করে এক নির্দেশনামা জারি করে। এই সমস্ত ব্যবস্থার ফলে জাতীয়কৃত হওয়ার আগেই উদ্যোগগুলির মূল্যবান জিনিসপত্র ও অন্যান্য সম্পত্তি গোপন বা অপসারিত করা শিল্পপতিদের পক্ষে দুষ্কর হয়ে ওঠে।

তেল শিল্পের চেয়ে চিনি শিল্প ছিল সবচেয়ে সংঘবদ্ধ শাখাগুলির একটি; প্রথমে যেসব শিল্প জাতীয়করণ করা হয়, চিনি শিল্প ছিল তার অন্যতম (২ মে, ১৯১৮)।

১৮ জুন তারিখে সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক পরিষদ সরমভো-কলোমনা গোষ্ঠীর কারখানাগুলোকে জাতীয়করণ করে। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির পর, গণকমিসার পরিষদ ২০ জুন তারিখে সমগ্র তেল শিল্পের জাতীয়করণের নির্দেশ নামা জারি করে।

ক্ষমতার কেন্দ্রীয় তথা স্থানীয় সংস্থাগুলি কারখানাগুলি জাতীয়করণ করেছিল। কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি - গণকমমিসার পরিষদ ও সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক পরিষদ - জাতীয়করণ করেছিল প্রধানত বড় উদ্যোগগুলিকে; স্থানীয় সংস্থাগুলি জাতীয়করণ করেছিল মুখ্যত ভোগ্য পণ্য উৎপাদনকারী উদ্যোগগুলিকে। রুটিকল, ময়দা কল, তুষ ছাড়ানোর কল ও চামড়া কারখানাগুলি জাতীয়করণ করা হয়েছিল সর্বপ্রথমে, কারণ সেগুলির কাজে কোন ছেদ পড়লে খাদ্য ভোগ্যপণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটত। জুলাই ১৯১৮-র শেষ দিক পর্যন্ত জাতীয়করণ করা হয়েছিল মোট ২,০৫৮টি বড়, মাঝারি ও ছোট কারখানা। 

কারখানাগুলিতে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ সাফল্যের সঙ্গে চালু হওয়া এবং লেনিনের পরিকল্পনার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক নির্মাণ কর্মের প্রথম অভিজ্ঞতার ফলে ডিসেম্বর ১৯১৭তে লেনিনের রচিত বৃহদায়তন শিল্পের মূল শাখাগুলির জাতীয়করণের কর্মসূচি কার্যকর করা সম্ভব হয়। 

২৮ জুন, ১৯১৮ তারিখে গণ-কমিসার পরিষদ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিগুলির মালিকানাধীন বড় বড় উদ্যোগগুলি জাতীয়করণ করে ঐতিহাসিক নির্দেশনামাটি জারি করে; এই শিল্পগুলি হল: খনি, ধাতুবিদ্যাগত, ধাতুকর্ম, সুতি বস্ত্র, বৈদ্যুতিক, গাছ-কাটা ও কাঠের কাজ, তামাক, রবার প্রভৃতি। এই নির্দেশ নামায় প্রায় ১৫০০টি জয়েন্ট স্টক কোম্পানির পরিচালিত কারখানাগুলি রাষ্ট্রের সম্পত্তিতে পরিণত হয়।

অর্থনৈতিক সংস্থাগুলি উৎপাদনের উপায় সমূহের সামাজিকীকরণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করায় কারখানাগুলির প্রলেতারীয় রাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তরিত হওয়া দরকার ছিল। প্রলেতারিয়েতের কাছে কারখানাগুলির আরও সংগঠিত হস্তান্তরের অবস্থা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ২৮ জুন ১৯১৮ তারিখের নির্দেশ নামায় বলা হয় যে প্রাক্তন মালিকরা থাকবে সাময়িক ইজারাদার হিসাবে। এই ব্যবস্থা জাতিব্যাপী স্তরে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে শ্রমিকদের ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পিত উত্তরণ নিশ্চিত করে। উদ্যোগগুলি যখন অধিগ্রহণ করা হয়, তখন সাজ-সরঞ্জাম কাঁচামাল ও জ্বালানির মজুত এবং অর্থ তহবিল মিলিয়ে দেখা হয়।

কারখানাগুলির জাতীয়করণে এবং সেগুলি জাতীয়করণের পর তাদের কাজ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নগুলি বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। ৩০ জুলাই ১৯১৮ তারিখে সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক পরিষদের সভাপতিমন্ডলী শিল্প জাতীয়করণ সম্পর্কিত নির্দেশনামা কাজে পরিণত করার রীতি পদ্ধতি সম্পর্কে কারখানা কমিটি, নিয়ন্ত্রণ কমিশন, সোভিয়েত সমূহ ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনগুলির জন্য নির্দেশাবলী প্রচার করে। 

ডিসেম্বর ১৯১৮তে অর্থনৈতিক পরিষদগুলির দ্বিতীয় কংগ্রেস এই কথা নথিবদ্ধ করে যে শিল্পের জাতীয়করণ মোটের উপর সম্পূর্ণ হয়েছে।

বৃহদায়তন শিল্প জাতীয়করণ করে সোভিয়েত ক্ষমতা রুশ ও বিদেশি পুঁজির উপরে মারাত্মক আঘাত হেনেছিল, তাদের বঞ্চিত করেছিল সোভিয়েত ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়বার অর্থনৈতিক ভিত্তি থেকে। উপরন্তু, বৃহদায়তন শিল্পের জাতীয়করণ ছিল সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক বনিয়াদ সৃষ্টির দিকে এবং গোটা জাতীয় অর্থনীতি ঢেলে সাজার দিকে নিয়ামক পদক্ষেপ।

সোভিয়েত কর্মনীতিকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে সামাজিক বিপ্লবের শত্রুরা জোর গলায় বলেছিল যে জাতীয়করণ অবিবেচনাপ্রসূত এবং তা চালানো হয়েছে কোন প্রণালীবদ্ধ ব্যবস্থা ছাড়াই, তা ছিল 'জবর দখলের নৈরাজ্যবাদী' প্রক্রিয়া। বস্তুতপক্ষে তা চালানো হয়েছিল রাশিয়ায় প্রকৃত বিদ্যমান অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বলশেভিক পার্টির তৈরি এক কর্মসূচি অনুযায়ী।

১৯১৮-র গ্রীষ্মকালের মধ্যে সোভিয়েত ক্ষমতা সমাজতন্ত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে তার প্রথম আস্থাপূর্ণ পদক্ষেপ করেছিল। সেই সময়ে অর্জিত অভিজ্ঞতা ছিল যুগান্তকারী তাৎপর্যপূর্ণ ।

লেনিন বলেছিলেন, 'একটা দেশ যখন গভীর পরিবর্তনের পথ গ্রহণ করেছে তখন সেই দেশের এবং সেই দেশে যে বিজয় অর্জন করেছে সেই শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির পক্ষে এটা কৃতিত্বের কথা যে আগে যেসব কাজ বিমূর্তভাবে তত্ত্বগতভাবে তুলে ধরা হতো সেই কাজে তারা ব্যবহারিকভাবে হাত দিয়েছে। এই অভিজ্ঞতা কখনোই বিস্মৃত হবার নয়..... ইতিহাসের তা লিপিবদ্ধ হয়েছে সমাজতন্ত্রের অর্জিত সাফল্য বলে, আর ভবিষ্যতের বিশ্ব বিপ্লব তারি উপরে গড়ে তুলবে তার সমাজতান্ত্রিক সৌধটিকে'।

[নির্দিষ্ট সূত্রগুলি চিহ্নিত করা হয়নি; সূত্রের জন্য মূল গ্রন্থ দ্রষ্টব্য] 

Picture Courtesy: Express to Russia

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার