তৃণমূল কংগ্রেসের শিক্ষা নীতি
বর্তমানে এই রাজ্যে শিক্ষার যা অবস্থা তাতে নতুন করে প্রবন্ধ লেখার দরকার পড়ে না। আলাদা করে সার্ভে করার দরকার পড়ে না এটা জানতে যে রাজ্যের সাধারণ মানুষ শিক্ষার হাল সম্পর্কে ক্ষুব্ধ কিনা। একদিকে শিক্ষার মান কমছে, আর অন্যদিকে চলছে ব্যাপক নিয়োগ দুর্নীতি। একদিকে পড়ুয়ার অভাবে ৮,২০৭টি সরকারী ও সরকারী অনুদান প্রাপ্ত প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় বন্ধ করার ঘোষণা করছে তৃণমূল সরকার আর অন্যদিকে হবু শিক্ষকরা নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে পুলিশের হাতে মার খাচ্ছে। আর এসবের মাঝে তৃণমূল সরকার ২০২৩-২৪ বাজেটের শিক্ষা খাতে ১৬.৫% বরাদ্দের থেকে ২০২৪-২৫ বাজেটে তা ১৫.৬%-এ কমিয়ে আনছে। কিন্তু ‘লেসার ইভিল’ তত্ত্বায়ণের চক্করে এসব কিছুই এখন তথাকথিত প্রগতিশীল মহলের বলা মানা। শিক্ষার প্রসঙ্গ উঠলেই নয় কেন্দ্র সরকারের জাতীয় শিক্ষা নীতি আর নইলে পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের শিক্ষা নীতি নিয়ে ভাষণ দেওয়ার ছলনা চলছে।
বামফ্রন্টের আমলের শিক্ষা ব্যবস্থার বহু ত্রুটি ও সমস্যা থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতির সাথে তার পার্থক্য এখানেই যে তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকালে শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষ করে সরকারী শিক্ষা ক্ষেত্র, একেবারে ভেঙে পড়েছে। তৃণমূল সরকার বিজেপির জাতীয় শিক্ষা নীতির বিরোধিতা করলেও তাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ অন্য কথা বলে। ২০১৫ সাল থেকে বিনা প্রতিবাদে, এক প্রকার চুপিসারে, তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্র সরকারের ‘এক দেশ, এক পাঠ্যক্রম’ নীতি প্রণয়ন করেছে। মেডিক্যাল প্রবেশিকা পরীক্ষা কেন্দ্রের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের ১৮ই মার্চ তৃণমূল সরকার কেন্দ্রের জাতীয় শিক্ষা নীতি (নেপ) লাগু করে এবং নেপ বিরোধী আন্দোলনের জেরে নিজেদের সুর পাল্টে তারা ৫ই সেপ্টেম্বর গ্যাজেট নোটিফিকেশান মারফৎ স্টেট এডুকেশান পলিসি (সেপ) নিয়ে আসে। মুখে নেপ বিরোধী কথা বললেও তৃণমূলের সেপ আসলে কেন্দ্রের নেপ-ই।
আপনি এই দ্বিচারিতা জেনে ফেলে ক্ষেপে গেলে আপনার হাতে শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা
বাধ্যতামূলক করার ললিপপ ধরিয়ে দেওয়া হবে। একদিকে কুরুখ, কুরমালী, সাঁওতালী, বোডো, কামতাপুরী,
রাজবংশী, নেপালী ভাষায় শিক্ষার বিষয়ে একপ্রকার কিছুই না বলে বিচ্ছিন্নতার বীজ বপন করা হচ্ছে আর অন্যদিকে ইংরেজী মাধ্যম সরকারী স্কুল খোলা হচ্ছে।
এই ভণ্ডামির মাঝে এটাও দেখা যাচ্ছে যে বাংলা মাধ্যম স্কুলের ইংরেজী পাঠ্য বইয়ের শোচনীয়
মান বামফ্রন্টের আমলের মতই রয়ে গেছে। ‘Blossoms’ নামের এই পাঠ্য বই ফ্রি-তে দেওয়া হলেও
কোনও ব্যাকরণ বই নেই! পাঠ্যক্রমের ব্যাকরণ শিখতে হলে ৩৫০ টাকা দিয়ে আলাদা করে বাজারের
বই কিনতে হয়, যার দামের উপর মধ্য শিক্ষা পর্ষদ কোনও নিয়ন্ত্রণ রাখেনি। আর সরকার ইংরেজি
মাধ্যম স্কুল খোলায় যারা নাচছেন তারা জেনে রাখুন, এই স্কুলগুলোতে বাংলা মাধ্যমের ওই
একই ইংরেজী পাঠ্য বই পড়ানো হচ্ছে। তারাও ইংরেজি পরীক্ষায় বোধপরীক্ষণ মার্কা (অর্থাৎ পাঠ্য বিষয় উত্তর
পত্রে ছাপাই থাকে) এক বাক্যে উত্তর লেখে! ফলে বহু এমন সরকারী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে
রয়েছে যেখানে পড়ুয়ারা ঠিক মত ইংরেজি বাক্য পড়তে লিখতে না পাড়ায় অন্যান্য বিষয় অধ্যয়নে
পিছিয়ে পড়ছে।
স্কুল স্তরে সরকারী পাঠ্য বই এমনভাবে লেখা হচ্ছে যা পড়লে মনে হবে
সেগুলো আসলে শিক্ষকদের পড়ানোর নির্দেশিকা মাত্র। ওই বইগুলো থেকে তথ্য উদ্ধার করে পরীক্ষার
উত্তর লেখা ছাত্রদের পক্ষে খুবই কঠিন ব্যাপার। আন্তর্জাতিক ইতিহাসের পাঠ তুলেই দেওয়া
হয়েছে। আইসিএসসি-র বইগুলো নকল করে একই পাঠ্যক্রম রেখে ছাপার খরচ কমানোর তাগিদে পৃষ্ঠা
সংখ্যা সীমাবদ্ধ করতে গিয়ে বিজ্ঞান বিষয়ক বইগুলোতে জরুরী তথ্যের উপর খাঁড়ার ঘা পড়ছে।
মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়ে কংগ্রেস আমলের কুখ্যাত গণটোকাটুকি
ও প্রশ্ন ফাঁস সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্কুল স্তরে ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে তৃণমূল
অধ্যুষিত পরিচালন সমিতির পকেটে ঘুষের টাকা ঢুকছে। পশ্চিমবঙ্গ
সর্ব শিক্ষা অভিযানের অধীন নির্মল বিদ্যালয় স্কিমের ফলাও প্রচার করা হলেও সরকারী স্কুলগুলোর
শৌচালয়ের অবস্থা খুবই শোচনীয়। মিড ডে মিলের নামে রোজ রোজ ডাল ভাত শিশুদের পেটে চড়া
পড়ালেও পাড়ার হুব্বাদের ঘুরপথে পকেট ভারী হচ্ছে। মিড ডে মিল কর্মীরাও ঠিক মত বেতন পান না, যদিও সাম্প্রতিক
আন্দোলনের জেরে শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য বরাদ্দ করা হয়েছে এবং কন্ট্র্যাকচুয়াল
রন্ধনকর্মীদের বেতন সামান্য বেড়েছে।
লকডাউন তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে পানশালাগুলোর উপর সরকারের প্রায়োরিটি
বেশি ছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা হয়েছে সবার শেষে, তাও বহু লড়াই আন্দোলনের পর
এই পদক্ষেপ নিতে এক প্রকার বাধ্য হয়েছে তারা। কেরালা সরকার লকডাউনের সময়ে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক
পরীক্ষা নিলেও এই রাজ্যে বিনা পরীক্ষাতেই দুই বছর ছাত্রদের পাশ করিয়ে তাদের শিক্ষাগত
ভীত নষ্ট করে দেওয়া হয়। বর্তমানে গরমের ছুটি বাড়ানোর ধুমে শিক্ষকদের পক্ষে পাঠ্যক্রম সম্পূর্ণ
করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
একদিকে পরিকাঠামো উন্নয়নের কোনও সদিচ্ছাই নেই সরকারের, তার উপর শিক্ষার
এই হাল… এ সব কিছুই আসলে তৃণমূল কংগ্রেসের শিক্ষার বেসরকারিকরণ নীতির নীল নকশা। নয়াউদারবাদী
অর্থনীতি এই রাজ্যে বাস্তবায়িত করতে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির তুলনায় কোনও কার্পণ্য করে
না। ফলে রমরমিয়ে বাড়ছে প্রাইভেট টিউশান সংস্থা ও প্রাইভেট
স্কুলের সংখ্যা। তাদের আকাশচুম্বী ফি অভিভাবকদের অসন্তোষের উদ্রেক ঘটালেও এলাকার শাসক
দলের মদতপুষ্ট গুন্ডাদের ফোকটে ইনকাম ভালোই হচ্ছে। মধ্য শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি থাকাকালীন
কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি প্রাইভেট টিউশান সংস্থার বিজ্ঞাপনে দেখা গিয়েছিল! এই
গুণধর ব্যাক্তি কিছুদিন হল নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় শর্ত সাপেক্ষ জামিনে জেল থেকে বেরিয়েছেন।
২০১৪ সালে ব্রাত্য বসু কলেজের ভর্তি প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ অনলাইন করার
ঘোষণা করলে মুখ্যমন্ত্রী ভর্তির নামে তোলাবাজি অক্ষুণ্ণ রাখতে তাকে সরিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর
পদে পার্থ চ্যাটার্জীকে নিয়ে আসেন। অর্থাৎ শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতি পরিচালন করতেই
তাকে নিয়ে আসা হয়।
‘The
West Bengal Universities and Colleges Administration and Regulation Act, 2017’ পাশ
করে তৃণমূল সরকার রাজ্যের অধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বশাসনের অধিকার খর্ব করার
চেষ্টা করে। এই আইন বলে স্নাতক স্তরের কলেজগুলোতে পরিচালন সমিতির প্রেসিডেন্টের পদে
সরকার নিজের পছন্দের প্রার্থীদেরকে বসানোর ব্যবস্থা করে।
উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনা বাধায়
নিজেদের তোলাবাজির সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের গুন্ডা বাহিনী লেলিয়ে
ছাত্র আন্দোলনের টুঁটি চিপে ধরার কাজ শুরু থেকেই করে এসছে তৃণমূল সরকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
শিক্ষার মানের প্রতি নজরদারির বদলে ছাত্রদের উপর চাপানো হয়েছে ক্লাসে উপস্থিতির নজরদারি।
তৃণমূল ছাত্র পরিষদের গুন্ডা বাহিনীর মাজদিয়া কলেজের অধ্যক্ষের উপর আক্রমণ, রাজাবাজার
সাইন্স কলেজের প্রফেসারকে নির্যাতন, ছাত্র ভর্তির নামে তোলাবাজি, বিনা নির্বাচনে ছাত্র
সংসদ দখল এবং যে কোনও সরকার বিরোধী আন্দোলনকে বাহু বলে খতম করার কিসসা সকলেরই জানা।
সুদীপ্ত গুপ্ত, মইদুল মিদ্যা, আনিস খান-রা শহীদ হয়েছে তৃণমূল জমানায়। ছাত্র সংসদ নির্বাচন
তুলেই দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার বেসরকারিকরণের তাগিদে শিক্ষা ক্ষেত্রের বিরাজনীতিকরণের
তত্ত্বায়ণ করতে মুখ্যমন্ত্রী একবার সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে এসে বলেন যে ছাত্র ইউনিয়নের
কাজ হল কেবল সরস্বতী পুজো করা এবং ফ্রেশার্স ও ফেস্ট অর্গানাইজ করা! ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে
থাকা অভিভাবকরা তখন আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু আজ সামান্য ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে
কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিগৃহীত হতে হয়।
লকডাউনের সময়ে কলেজগুলোতে অনলাইন পরীক্ষার
নামে টুকে পাশ করার ধুম এবং লকডাউন উঠে গেলেও এই পরীক্ষা পদ্ধতির উপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে
তৃণমূল ছাত্র পরিষদ ২০২২ সালে আবারও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন পরীক্ষার দাবীতে
ঝামেলা শুরু করে! কিন্তু এরাই লকডাউনের সময়ে পাশের হার বেড়ে যাওয়ায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
বিভিন্ন বিভাগগুলোতে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ভর্তি প্রক্রিয়ার সমাপ্তির পরেও উচ্চ শিক্ষা
অর্জনে ইচ্ছুক স্নাতক উত্তীর্ণ পড়ুয়াদের সুযোগ দেওয়ার দাবীতে ‘অকুপাই সিইউ’-এর আন্দোলনের
বিরোধিতা করে।
তৃণমূল সরকারের পছন্দের ব্যাক্তিরা উপাচার্যের পদে বসে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের
ছাত্র বিরোধী অবস্থানের উজ্জ্বল উপস্থিতি রেখেছে। ২০১৫ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত
ছাত্রদের উপর পুলিশ লেলিয়ে উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী ‘হোক কলরব’ আন্দোলনের সম্মুখীন
হয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূল ঘনিষ্ঠ উপাচার্য
অনুরাধা লোহিয়া ছাত্র আন্দোলনের টুঁটি চিপে ধরতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন, বিভিন্ন
ডিপার্টমেন্টের জন্য প্রাইভেট বিনিয়োগের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন, শিক্ষকদের সংগঠন
প্রতিষ্ঠায় বাধা দেন এবং ২০১৩ সালে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ দ্বারা পদার্থবিদ্যা বিভাগের
গবেষণাগার তছনছ করার ঘটনাকে অস্বীকার করেন। আর মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ছাত্র আন্দোলনের সময়ে কলেজ কর্তৃপক্ষকে
পোস্টার ছুঁড়ে মারা, আন্দোলনকারী ছাত্রের গলা টিপে ধরার মত শারীরিক আক্রমণের ঘটনাও
ঘটেছে।
কলিকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটা স্নাতকোত্তর বিভাগ অন্যান্য অ্যাফিলিয়েটেড কলেজের ছাত্রছাত্রীদের
সমসুযোগের অধিকার খর্ব করে নিজেদের ইচ্ছে মত পড়িয়ে, সেটাই কেন্দ্রীয় পাঠ্যক্রম হিসেবে
গণ্য করে, কেন্দ্রীয় পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরির দায়িত্ব নিজেদের হাতেই রাখার দুর্নীতিতে
যুক্ত রয়েছে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে সরকারী অনুদান প্রাপ্ত অ্যাফিলিয়েটেড কলেজগুলোতে না পড়ে পড়ুয়াদের অটোনমাস প্রাইভেট কলেজে যাওয়ার প্রবণতা বাড়বে।
ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইউনিভার্সিটি-তে কান ঘেঁষে পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের ফেল করিয়ে উত্তর পত্রের পুনর্মূল্যায়নের নামে কর্তৃপক্ষের অর্থ রোজগারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রাজ্য সরকারের অধীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদের ফেল করানোর প্রবণতা রয়েছে। একবার সাপ্লিমেন্টারী পেলেই বছর নষ্ট! ২০১৬ সালে ‘গর্জে ওঠো সিইউ’ আন্দোলন শুরু হয়। সেই সময়ে এটা জনসমক্ষে চলে আসে যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোতে নির্ধারিত আসনের চেয়ে প্রায় ২৫০% বেশি পড়ুয়াদের ভর্তি নেওয়া হয় এবং ইউজিসি-র সামনে সাধু সাজতে সিলেকশান টেস্ট এবং প্রথম বর্ষের পরীক্ষাতেই বিপুল পরিমাণ ছাত্রছাত্রীকে ফেল করানো হয়। ফেলের সংখ্যা বাড়াতে ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় নোটিফিকেশান জারী করে যে একটি পাসের বিষয়ে ফেল করলেই বছর নষ্ট হবে! ছাত্র আন্দোলনের চাপে এই দুর্নীতি ফাঁস হয়ে গেলে ওই নোটিফিকেশান ফেরত নেয় সিইউ কিন্তু পাস বা অনার্স যে কোনও বিষয়ে একবার ফেল করলেই বছর নষ্ট করানোর নির্দেশিকা এখনও ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইউনিভার্সিটি বহাল রেখেছে।
পলিটেকনিক কলেজগুলো ধুঁকছে। সেপ-এ পাস কোর্সের অস্তিত্ব থাকবে কিনা আর এর কর্মসংস্থানগত ভবিষ্যৎ কি তা বলা মুশকিল। বিগত ১০ বছরে নতুন সরকারী বিএড কলেজ খোলা হয়নি। কিন্তু ব্যাঙের ছাতার মত প্রাইভেট বিএড কলেজ গজিয়ে উঠছে যাদের কোর্স ফি গগন চুম্বী এবং ডিগ্রীর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই এদের দরজায় ঝাঁপ পড়ে যায়। নিজের পছন্দের বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা প্রাপ্তির খরচের চেয়ে বিএড করতে বেশি খরচ সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান ব্যবসায়িক বৈশিষ্ট্যগুলোকে তুলে ধরে। সরকারী এবং সরকারী অনুদান প্রাপ্ত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোমর ভেঙে দিয়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির বাজার উন্মুক্ত করার চেষ্টা চলছে।
২০২২ সালে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জীকে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগে এনফোর্স্মেন্ট ডিরেক্টোরেট (ইডি) গ্রেফতার করে। তারা নিয়োগ সংক্রান্ত প্রায় ৫০ কোটি ঘুষের টাকা পার্থ-র সহচরী অর্পিতা মুখার্জীর ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করে। পার্থর গ্রেফতারীর পর তার স্ত্রী বাবলি চ্যাটার্জীর নামে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায় বিসিএম ইন্টারন্যাশনাল স্কুল-এর অস্তিত্ব জনসমক্ষে চলে আসে। অর্থাৎ শিক্ষামন্ত্রী নিজেই প্রাইভেট স্কুলের ব্যবসা খুলে বসেছিলেন। স্কুলটি তৈরি করে তার জামাই কল্যাণময় ভট্টাচার্য্য।
শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলের তালিকায় কৃতকার্যদের প্রাপ্ত নম্বর
উল্লেখ না করে ঘুষের টাকার পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। অশিক্ষক কর্মচারীদের পরীক্ষাগুলো
প্রতি বছর নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে তৃণমূল সরকার আর নিলেও দুর্নীতির অভিযোগে হাই কোর্টে
প্যানেল বাতিল হচ্ছে। নীচে রইল নিয়োগ দুর্নীতির কয়েকটা নমুনা:
ক্ষেত্র |
নিয়োগ দুর্নীতি |
২০১২ লোয়ার প্রাইমারি টেট |
তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ডের
অধীনে প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগের জন্য টেট (টিচার্স এলিজিবিলিটি টেস্ট) পরীক্ষার
ব্যবস্থা করে। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর আমলে ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার্স এডুকেশন
(এনসিটিই)-র প্রস্তাব অমান্য করে এই পরীক্ষায় বসার যোগ্যতা রাখা হয় উচ্চ-মাধ্যমিক
স্তরে ৫০% নম্বর এবং সংরক্ষিত পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ৪৫% নম্বর ধার্য হয়। যোগ্যতার
মান এতটা কমিয়ে পরীক্ষায় বসার জন্য ৫৫ লক্ষ প্রার্থীর থেকে ফি আদায়ের পাশাপাশি বহু
অযোগ্য প্রার্থীদের ঘুষের বিনিময়ে চাকরী দেওয়ার দুয়ার উন্মুক্ত করা হয়। প্রশ্নপত্র
ফাঁস, ওএমআর শিট পরিবর্তন ও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এই দুর্নীতিতে নাম জড়ায় তৃণমূল
বিধায়ক বিশ্বজিৎ কুণ্ডুর। উত্তর ২৪ পরগণার ডিস্ট্রিক্ট
প্রাইমারী স্কুল কাউন্সিল (ডিপিএসসি)-এর চেয়ারম্যান সম্রাট মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। |
২০১৩ ও ২০১৭-র স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রবেশিকা
পরীক্ষা |
স্কুল সার্ভিস
কমিশন গ্যাজেট নোটিফিকেশান মেনে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেনি। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের এসএসসি-র প্যানেল সংক্রান্ত
দুর্নীতির অভিযোগে নাম জড়ায় ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে আগত পরেশ অধিকারীর।
|
রাষ্ট্রীয়
মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান, ২০১৩-১৭ |
সরকারী এবং সরকারী অনুদান প্রাপ্ত স্কুলগুলোয় রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান-এর অধীন প্রায় ৬,৫০০ কম্পিউটার শিক্ষক ২০১৩ থেকে ২০১৭-র মধ্যে কন্ট্র্যাকচুয়াল হিসেবে নিযুক্ত হলেও জয়েনিং লেটার না মেলায় এবং মাত্র ৬,৫০০ টাকা মাসিক বেতনের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে ধর্নায় বসে। |
২০১৪ প্রাইমারী টেট |
২০১৪
প্রাইমারী টেট উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের একাংশকে ‘নট-ইনক্লুডেড’ তালিকাভুক্ত করে জানানো
হয় যে তাদের পরবর্তীকালে মেধা তালিকা অনুযায়ী পোস্টিং দেওয়া হবে কিন্তু সেই প্রক্রিয়া
আর কোনোদিন শুরু হয়নি। উল্লেখ্য, রাজ্য সরকারের নিজস্ব ঘোষণা অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে
২০,০০০ শূন্যপদ ছিল। |
স্টেট লেভেল সিলেকশান টেস্ট |
নবম থেকে
দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত এসএলএসটি-তে শিক্ষকদের স্বচ্ছ নিয়োগের দাবীতে আন্দোলন চালাচ্ছেন
হবু শিক্ষকরা। |
WBGDRB-2017 Group-D Waiting |
WBGDRB-2017
Group-D Waiting চাকরী প্রার্থীদের মেধা তালিকায় নামের পাশে প্রাপ্ত নম্বর দেওয়া
হয়নি। Waiting-এর মেধা তালিকা P&AR দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে সেই অনুযায়ী
নিয়োগ করা হচ্ছে না। কয়েকজন মেধা তালিকায় অনেকটা পিছনে থাকা Waiting প্রার্থীর চাকরীর
পদ সংক্রান্ত স্ট্যাটাস হঠাৎ করে ‘Waiting for Posting’ দেখাতে শুরু করে। আন্দোলনকারীরা
এই প্রক্রিয়ার নাম দিয়েছেন ‘ভূতুড়ে আপডেট’। উল্লেখ্য, রাজ্য সরকারের নিজেরই ঘোষণা
অনুযায়ী এই ক্ষেত্রে প্রায় ৬০০০ শূন্যপদ রয়েছে!
|
২০১৯ আপার প্রাইমারি টেট |
ইন্টার্ভিউতে পরীক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর পেনসিলে লেখার উপদেশ
দেওয়া হয় যাতে পরীক্ষকদের অনুপস্থিতিতে ঘুষের টাকার ভিত্তিতে নম্বর পরিবর্তন করে
দেওয়া যায়। বর্তমানে টেট উত্তীর্ণ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত
আন্দোলনকারীরা গ্যাজেট নোটিফিকেশান অনুযায়ী আসন সংখ্যা আপডেট করে ১:৩৫ শিক্ষক-ছাত্র
অনুপাত মেনে সরকারী শূন্যপদে নিয়োগের দাবীতে লড়াই করছে। |
তৃণমূল সরকার চাকরী প্রার্থীদের বহুবার মিথ্যা
আশ্বাস দিয়েছে, কখনও আন্দোলনকারীদের উপর
নামিয়েছে পুলিশি আক্রমণ। অনেক হবু শিক্ষককে গ্রেফতার করে পুলিশ হেফাজতে শারীরিক
ও মানসিক হেনস্থা করা হয়েছে। উপরের তালিকা বুঝিয়ে দেয় এই দুর্নীতির শিকড় কতটা গভীর।
আর হবে নাই বা কেন? ২০১৪ সালে চিট ফান্ড দুর্নীতি ফাঁস হয়ে গেলে পার্টির কোষাগারে লক্ষ্মী
আগমনের নয়া পন্থা হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষা ক্ষেত্রে তোলাবাজি ও শিক্ষক নিয়োগে বাধ্যতামূলক
ঘুষ! তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় অন্তত স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে একটা নির্দিষ্ট
সময়ের পর প্যানেল বাতিল হয়ে যায় তাই আন্দোলনকারীদের কোনও সুরাহাই আর সরকার করতে পারবে
না কিন্তু হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠতে গিমিক
করতে করতে শেষে আইনি জটিলতা বুঝে শুধু কেটে পড়েননি বরং নিজের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে
বিজেপির নির্বাচনী প্রার্থী হয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আরএসএস-এর সংগঠন কত নিবিড়। রাজ্য সরকারের
‘ডিলে ট্যাকটিক্স’ আর কোর্ট ব্যবস্থার শ্লথতা আন্দোলনকারী চাকরী প্রার্থীদের কাঙ্ক্ষিত
ন্যায় থেকে বঞ্চিত করল শুধু নয়, রাস্তার লড়াইয়ের প্রতি হতাশাও তৈরি করল। বর্তমানে হাই কোর্ট যোগ্য ও অযোগ্য প্রার্থীদের মধ্যে বিভেদ না করে ২০১৬-র এসএসসি-র ২৫,০০০ নিযুক্ত শিক্ষকের প্যানেল বাতিল করেছে। রাজ্য সরকারের দুর্নীতির ফল ভুগছে যোগ্য প্রার্থীরাও। হাই কোর্টের কেবল অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ বাতিল করা উচিৎ ছিল। এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা উঠলে প্রধান বিচারপতি এই নিয়োগ প্রক্রিয়াকে 'সিস্টেমিক ফ্রড' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
পূর্ণ শিক্ষকদের মত কাজ করলেও সরকারী এবং সরকারী অনুদান প্রাপ্ত
স্কুলের পার্শ্ব শিক্ষকরা বেতনের বদলে সামান্য কিছু টাকার ভাতা পান। ভাতা বন্ধ করে
নির্দিষ্ট পে স্কেল নির্ধারণের দাবীতে তাদের আন্দোলনের জেরে মাঝে মাঝে তৃণমূল প্রশাসন
কেবল সামান্য কিছু টাকা বাড়িয়ে দেয়। কলেজগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে প্রায় ৫ বছর অন্তর!
WBCSC পরীক্ষায় বিলেত ফেরতদের জন্য অতিরিক্ত নম্বর ধার্য করে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা
বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সরকারী কিংবা সরকারী অনুদান প্রাপ্ত কলেজগুলোতে শিক্ষকতায় ঠিকা
প্রথাকে মান্যতা দিয়ে ২০২০ সালে একবারই গেস্ট লেকচারারদের State Aided College
Teacher (SACT)-এ পরিণত করে খুবই সামান্য মাস মাইনে
দেওয়া হচ্ছে। গেস্ট টিচার নেওয়া বন্ধ করার নির্দেশিকা জারী করে বিপল শূন্যপদের মাঝে রাজ্য
সরকার ঘুরপথে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বারা গেস্ট শিক্ষকদের শোষণের পথ প্রশস্ত
করেছে। এনাদের কোনও জয়েনিং লেটার দেওয়া হয় না। অটোনমাস প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব নিয়োগ করার অধিকার থাকলেও তারা ইউজিসি-র নিয়মকে
বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গেস্ট টিচারদের ক্লাস প্রতি ২৫০/৩০০/৩৫০/৫০০ টাকা দিচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী
নিজে একবার ক্লাস প্রতি ১৫০ টাকার প্রস্তাব দিয়ে নিন্দিত হন।
অর্থাৎ শিক্ষা প্রসঙ্গে নয়াউদারবাদী প্রেস্ক্রিপশান মেনে তৃণমূল কংগ্রেস বেসরকারিকরণের উদ্দেশ্যে সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বিনষ্ট করে শিক্ষাক্ষেত্রে ঠিকা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে এবং নিজেদের পকেট ভরাতে তোলাবাজির স্বর্গ রাজ্য সৃষ্টি করেছে।
Comments
Post a Comment