ট্রাম্পের ট্যারিফ নীতি ভারতের উপর কি প্রভাব ফেলছে বা ফেলতে পারে?

প্রিয়াংশু দে


আগের প্রবন্ধে (https://thediligent2018.blogspot.com/2025/04/blog-post.html) ট্রাম্পের ট্যারিফ নীতি সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। এবারে দেখে নেওয়া যাক ট্রাম্পের দ্বিতীয় টার্মে নেওয়া ট্যারিফ সিদ্ধান্তের কিরকম প্রভাব ভারতের উপর পড়তে পারে। ২রা এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত থেকে আগত বিভিন্ন পণ্যের ওপর ট্যারিফ আরোপ করে। এটিও তাদের 'America First' অ্যাজেন্ডার অংশ। তাদের দাবি, ভারত সরকার তাদের পণ্যের ওপর যতটা ট্যারিফ নেয় তার সাথে সামঞ্জস্য সাধন করার জন্যই নাকি এই ট্যারিফ প্রণয়ন অর্থাৎ এগুলো নাকি 'reciprocal tariff' (এই গল্প যে ডাহা মিথ্যা তা আগেই বলা হয়েছে)। এবার দেখে নেওয়া যাক ভারতীয় অর্থনীতির কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র এই নীতির দ্বারা আহত হচ্ছে বা হতে পারে।  

মার্কিন সরকার সমস্তরকম গাড়ির আমদানির ওপর ট্যারিফ বাড়িয়ে ২৫% করে দেওয়ায়, ভারতে তৈরি গাড়ির রপ্তানিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ঔষধ ও সেমিকন্ডাক্টরের ওপর ২৫% বা তার বেশি ট্যারিফ চাপানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। মার্চের ১২ তারিখ, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ট্যারিফ ১০% থেকে বাড়িয়ে ২৫%-তে নিয়ে যাওয়া হয়। এছাড়া ২রা এপ্রিল কৃষিজাত পণ্যের ওপর নতুন ট্যারিফ লাগু করা হয়। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত থেকে এইসব পণ্য আমদানি করে, তাই ভারতের অর্থনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতে এর ফলে ভারত মার্কিনী পণ্যের ওপর ট্যারিফের হার কমাবে। এবার দেখেনি যে ভারত এই পরিস্থিতিতে কি পদক্ষেপ নিয়েছে? 

ভারত সরকার এই আগ্রাসী ট্যারিফ নীতির প্রভাব কমাতে কিছু কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা অনুসন্ধান করছে যে আলোচনার মাধ্যমে এই ট্যারিফ পরিকল্পনাকে স্থগিত রাখা যায় কিনা যতদিন না Bilateral Trade Agreement অবধি পৌঁছানো যাচ্ছে, যেটি এবছরের শেষার্ধে হওয়ার কথা। তাছাড়া সাম্প্রতিক মার্কিনী উপরাষ্ট্রপতি জে.ডি. ভ্যান্স-এর ভারত সফর দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক পোক্ত করার ইচ্ছারই ইঙ্গিত দিচ্ছে এবং দুই দেশই নিজেদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের বৃদ্ধি ঘটিয়ে ২০৩০-এর মধ্যে তা $৫০০ বিলিয়নের কাছাকাছি অঙ্কে নিয়ে যেতে চায়। এই প্রতিকূলতার মধ্যেও ভারতীয় অর্থনীতি সামান্য প্রত্যাবর্তন করেছে। Nifty ও Sensex-এর মতো ভারতীয় স্টক মার্কেট বেঞ্চমার্ক প্রথমে একেবারে মুখ থুবড়ে পড়লেও পরে একটু উঠে দাঁড়িয়েছে। এর সম্ভবত কারণ, ট্রাম্পের কিছু ট্যারিফে ছাড়ের প্রস্তাব ও কিছু লেভি প্রণয়নে ৯০ দিনের দেরীর সম্ভাবনা।এই মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের $৪ বিলিয়ন ভারতীয় স্টকে বিনিয়োগ বিক্রি করে পালালেও, ভারতীয় বিনিয়োগকারী ও বিনিয়োগ সংস্থারা তাদের বিনিয়োগ বহাল রেখেছে। 

H-1B Visa ধারণের নিয়ম আরও কঠিন করার প্রস্তাবের প্রভাব ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী ও তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাদের ওপর পড়বে, যারা মার্কিনী বাজারের ওপর বেশি নির্ভরশীল। এছাড়া সুইস ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ ABB-র মত কিছু সংস্থার দ্বারা আঞ্চলিক মার্কিনী বাজারে উৎপাদন বৃদ্ধি Global Supply Chain-এর থেকে একটু হলেও সরে আসার দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে, যার প্রভাব ভারতে পড়বে। মার্কিন সরকার $৫.১ বিলিয়নের তথ্যপ্রযুক্তি সেবার কন্ট্রাক্ট বাতিল করায় Deloitte আর Accenture-এর মত কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা TCS ও Infosys অক্ষত রয়েছে। সম্প্রতি টিকটকে চীনা কন্টেন্ট ক্রিয়েটাররা পশ্চিমী ফ্যাশান হাউসদের পর্দা ফাঁস করে দিয়েছে, চীনা পণ্যের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চড়া হারে ট্যারিফ লাগু করার প্রতিশোধ নিতে। তারা দেখিয়েছে যে নামি-দামি luxury fashion পণ্য চীনা কারখানাতে উৎপাদন করা হয়, আর যে ফ্যাশান হাউসদের নিজেদের পণ্য নিজেদের ইউনিটে বানানোর গল্প বিখ্যাত ছিল তা মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে। 

ভারত সবচেয়ে বেশি আমদানী করে চীন থেকে (১৫%) এবং সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (১৭%)। ভারত $৭৮ বিলিয়ন অঙ্কের রপ্তানি করে মার্কিন মুলুকে। সাম্পগ্রিকভাবে ট্রাম্পের ট্যারিফ নীতির ফলে ভারতের কৃষি পণ্য রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, বস্ত্র শিল্পের চাহিদা কমবে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের কৃষক, ক্ষেত মজুর ও বস্ত্র শিল্পের ঠিকা শ্রমিকরা। কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির ফলে যানবাহনের দাম বাড়বে। ফার্মা কম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক সীমাবদ্ধতা দেশের জনতার উপর অতিরিক্ত ওষুধের দাম চাপিয়েই উসুল হবে। ধনকুবেরদের তরফে ইতিমধ্যেই ব্যবসা করার খরচ কমানোর নিদান দেওয়া হচ্ছে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হল ছাঁটাই আর ঠিকা শ্রমিকদের বেতন হ্রাস ও কাজের অনিশ্চয়তা। ফলে পরিত্রাণের উপায় হল বিকল্প রপ্তানি ক্ষেত্র অনুসন্ধান ও ডলার ব্যতীত লেনদেনের অক্ষ তৈরির প্রস্তুতি নেওয়া। এই দ্বিতীয় উপায় প্রণয়ন করতে গেলে দরকার আমাদের দেশের কেন্দ্র সরকারে বাম মনোভাবাপন্ন পার্টির আসীন হওয়া। তাই ভবিষ্যৎ লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বামপন্থীদের জাতীয় স্তরেও 'নেমে খেলতে হবে'।  

পড়ুনঃ https://thediligent2018.blogspot.com/2023/07/overcoming-inflation-transfer.html  

তথ্যসূত্র

১. Donald Trump expects India to cut tariffs on US products, but 'will charge them the same from April 2'; Hindustan Times 

২. Trump believes India will lower duties on US goods, but reciprocal tariffs are to begin April 2; Business Today 

৩. Donald Trump's tariffs: India may be among least vulnerable Asian economies in trade war with US - but there's a catch!; The Times of India 

৪. India-US Trade Relations Under Trump’s Tariffs; Archana Rao; India Briefing

৫. Trump Says India Won’t Avoid Being Hit by Tariffs on April 2; Ruchi Bhatia; Bloomberg 

৬. India's Sensex erases post-tariff losses as Trump signals exemptions; Bharath Rajeswaran and Vivek Kumar M; Reuters 

৭. Govt explores plan to negotiate suspension of 26% tariffs till bilateral trade agreement is finalised with US; Business Today 

৮. Vance and Modi are likely to discuss a potential US-India trade deal. Here’s what to know; Shaikh Saaliq; AP News

৯. India File: Investors look homeward for safe harbours; Ira Dugal; Reuters 

১০. US election results 2024: Experts warn of higher tariffs on Indian goods under Trump's 'America First' policy; The Times of India 

১১. ABB to increase local US production to reduce tariff impact; John Revill; Reuters

১২. Trump tariffs can have three-round impact on India's growth: CEA V Anantha Nageswaran; moneycontrol.com

১৩. Trump tariffs: Can India navigate the global tariff war? Impact to key partners—Here’s a 5-point analysis; Nikita Prasad; livemint.com 

Picture Courtesy: Craiyon AI

Comments

Popular posts from this blog

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?